ওয়ার্ল্ড ডিজনি স্টুডিওতে অ্যানিমেশনকে কীভাবে নিখুঁত ও বাস্তবসম্মত করা যায় তা নিয়ে কাজ করেছিলেন দুই মহারথী। তাদের একজন হলেন থমাস ফ্রাংক, অপরজন ওলিয়ে জনসটন। ১৯৩০ সালে তাদের নিরলস চেষ্টায় উদ্ভাবিত হলো অ্যানিমেশনের ১২টি নিয়ম। অ্যানিমেশনকে তারা এক নতুন আর্টফরম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। অ্যানিমেশনে একটি বস্তুকে কীভাবে গতিশীল করলে তা অধিকতর বাস্তবানুগ হবে অথবা একটি ক্যারেক্টারের নড়াচড়া কেমন হলে তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পাবে এসবই ওই ১২টি নিয়ম দিয়ে তৈরি করা যায়। থমাস ফ্রাংক এবং ওলিয়ে জনসটনের যুগান্তকারী বই ‘ইলিউশন অফ লাইফ’-এ এই নিয়ম বর্ণিত আছে। নিয়মগুলো হলো:
০১. স্কোয়াস এন্ড ট্রেস-(Squash and Stretch) :
এই ক্রিয়ার ফলে গতিশীল বস্তুতে আয়তন ও ওজনের অনুভব হয়। কোনো ক্যারেক্টারের মুখমণ্ডলের প্রকাশভঙ্গিতেও এর প্রভাব আছে। লাফানো বল (Bouncing Ball) এর এ্যানিমেশন থেকে শুরু করে ক্যারেক্টারের হাঁটাচলার অ্যানিমেশন তৈরিতে স্কোয়াস ও ট্রেস নিয়মের ব্যবহার আছে। কাজেই একজন অ্যানিমেটরকে এই নিয়মটি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
০২. অ্যান্টিসিপেশন (Anticipation):
কোনো ক্যারেক্টারের একটি কাজ করার আগের যে প্রস্তুতিমূলক নড়াচড়া তাই হলো অ্যান্টিসিপেশন। যেমন ঢিল ছোড়ার আগে হাতের পেছন দিকের গতি অথবা লাফ দেয়ার পূর্বে প্রস্তুতিমূলক দেহভঙ্গি ইত্যাদি।প্রায় সব বাস্তব ক্রিয়াতেই অ্যান্টিসিপেশন থাকে। এটাকে এক কথায় বলা যায় ক্রিয়ার আগের ক্রিয়া (Action before Action)।
০3. স্টেজিং (Staging):
এটা হলো কোনো ক্যারেক্টারের নির্দিষ্ট ভঙ্গিমা (Pose) বা ক্রিয়া যা তাকে দর্শকের সম্মুখে ভালোভাবে উপস্থাপন করে। এর ফলে গল্পের মুড ও ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়। ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল এবং বিভিন্ন শট যেমন লং শট, মিউল শট, ক্লোজড শট ইত্যাদির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে সফলভাবে স্টেজিং ক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। সাধারণত সিনেমাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে বিশাল একটি কাহিনিকে উপস্থাপন করতে হয়। কাজেই শটগুলো এমন হতে হবে যেন প্রতিটি ক্রিয়া ভালোভাবে দর্শক বুঝতে পারে। ফোরগ্রাউন্ড বা মূল বস্তুর সাথে ব্যাকগ্রাউন্ডের সঠিক সমন্বয়ও সফল স্টেজিং-এর জন্য জরুরী।
০৪. স্ট্রেইট এহেড এন্ড পোজ টু পোজ অ্যানিমেশন (Straight Ahead and Pose to Pose Animation): অ্যানিমেশনের পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে সৃষ্টিশীলতার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার জন্যে একজন অ্যানিমেটর শুরু থেকেই তার ড্রইং বা ক্রিয়াকে খুবই তরতাজা (Fresh) রাখা চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় পোজ বা ক্যারেক্টারের ভঙ্গিমাগুলো কোনো পরিকল্পনা অনুসারে করা হয় না। পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে একটি স্বাধীন ভাব থাকে। কিন্তু পোজ টু পোজ এর ঠিক বিপরীত প্রক্রিয়া। এখানে অ্যানিমেটর পরিকল্পনামাফিক শুরু এবং শেষের পোজ নির্ধারণ করে থাকেন। মাঝের পোজগুলো মধ্যবর্তী ফ্রেমগুলোতে এমনভাবে সেট করা হয় যেন পুরো বিষয়টার মধ্যে একটা গতিশীলতা থাকে। অর্থাৎ এক পোজ থেকে আরেক পোজে যাওয়ার মাঝে গতির প্রকাশ ঘটে।
০৫. স্লো আউট স্লো ইন (Slow out and Slow in):
কোনো বস্তুর গতিকে বাস্তবসম্মত ভাবে উপস্থাপন করার অন্যতম একটি প্রক্রিয়া স্লো আউট স্লো ইন। স্থির বস্তু ক্রমান্বয়ে গতি বাড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট গতি লাভ করে এবং থামার পূর্বে একইভাবে গতি কমিয়ে থামে। ত্বরণ-মন্দনের (Accleration-Deceleration) নিয়ম কার্যকর হয়। প্রাকৃতিক কোনো গতি হঠাৎ শুরু হয়ে শেষ হয় না।
০৬. আর্ক (Arc):
যান্ত্রিক অ্যানিমেশন ছাড়া সব গতিই বৃত্তচাপ অনুসরন করে। এই প্রক্রিয়াটি মানুষ এবং অন্যান্য জীবজন্তুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয়। একটি সরল দোলকের (Simple Pendulum) ভরটি গতিশীল অবস্থায় বৃত্তের চাপ কে তার গতিপথ হিসাবে বেছে নেয়।
ঠিক তেমনি ভাবে মানুষের হাত বা মাথা নড়াচড়া করে।
০৭. সেকেন্ডারি অ্যাকশন (Secondary Action) :
ক্যারেক্টার অ্যানিমেশনের ক্ষেত্রে এই ক্রিয়াটি মূল ক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করে। এটি বিভিন্ন ছোটখাটো নড়াচড়া যোগ করে মূল অ্যানিমেশনকে জটিল এবং বাস্তবের মতো করে তোলে।
০৮. টাইমিং (Timing):
অভিজ্ঞতা থেকে অ্যানিমেশনে টাইমিং-এর দক্ষতা তৈরি হয়। কোনো বস্তুর গতি বা ক্যারেক্টারের কোন অংশের নড়াচড়ার অর্থ বুঝতে টাইমিং ক্রিয়া জরুরি। ধরা যাক, কোনো মানুষ তার মাথা ডান-বামে নাড়ার গতির ওপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ পেতে পারে। দ্রুত মাথা নাড়া না বোধক ভঙ্গিমা বোঝাতে পারে, আবার একটু কম গতিতে মাথা ডানে, বামে নাড়লে শরীর চর্চা মনে হতে পারে। কেউ একজন একটি টেবিলে দ্রুত কোনো বই রাখলে তার রাগান্বিত মনোভাব বোঝাতে পারে। আবার বই রাখার সময় বাড়িয়ে দিলে এই ক্রিয়াটি স্বাভাবিক মনে হবে।
০৯. ইগ্ন্জাজারেশন (Exaggeration):
অ্যানিমেশনকে মজাদার করে তোলার জন্যে ইজাজারেশন গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া। এর সাহায্যে কোনো একটি ক্রিয়াকে অনেক বিবর্ধিত করে দেখানো হয়। যদিও এই প্রক্রিয়াটি একটি অবাস্তব গতি তৈরি করে তা সত্ত্বেও কার্টুন অ্যানিমেশনে এই ধরনের ক্রিয়া একঘেয়েমি ভাব কাটাতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।
১০. সলিড ড্রয়িং (Solid Drawing):
বিশেষভাবে দ্বিমাত্রিক অ্যানিমেশনে কোনো ক্যারেক্টর বা বস্তুর আয়তন বা ওজন বুঝাতে সলিড ড্রয়িং প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সলিড ড্রয়িং এর দক্ষতা একজন ক্লাসিকাল অ্যানিমেটরকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ক্যারেক্টরকে আঁকতে বা উপস্থাপন করতে সাহায্য করে।
১১. অ্যাপিল (Appeal):একজন বাস্তব অভিনেতার কারিশমা থাকে। একইভাবে একটি কার্টুন ক্যারেক্টরকে আবেদনময়ী হয়ে উঠতে হয়। এই অ্যাপিলের জন্যেই দর্শক ক্যারেক্টরকে পছন্দ করবে- মনে রাখবে। ক্যারেক্টার ডিজাইন এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। একটি ক্যারেক্টরের ডিজাইন এমনভাবে করা হয় যেন পর্দায় আবির্ভারের সাথে সাথেই দর্শক বুঝে যায় সে কী? কী তার পরিচয়? সে কি হিরো অথবা ভিলেন? ক্যারেক্টরের চোখ মুখের গঠন থেকে শুরু করে তার পোশাক আশাক এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১২. ফলো থ্রো এবং ওভারল্যাপিং অ্যাকশন (Follow Throw and Over Laping Action):
ফলো থ্রো অ্যান্টিসিপেশনের বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। আমরা জানি অ্যান্টিসিপেশন হলো কোনো ক্রিয়ার প্রস্তুতিমূলক ক্রিয়া। ফলো থ্রো হলো কোনো ক্রিয়ার শেষের ক্রিয়া। চলমান বা গতিশীল কোনো ক্যারেক্টার হঠাৎ থেমে গেলে তার শরীরের অন্যান্য অংশ তখনো গতিশীল থাকতে পারে। একসঙ্গে শরীরের সব অংশের গতিশীলতা থেমে যায় না। অ্যানিমেশনে এই প্রক্রিয়াই ফলো থ্রো হিসেবে পরিচিত। পদার্থবিজ্ঞানের বস্তুর জড়তা ধর্ম এখানে ভালোভাবে প্রতিফলিত হয়। ওভারল্যাপিং ক্রিয়া অ্যানিমেশনে সহজাত অনুভূতি তৈরি করে। কোনো বস্তুর সাথে যুক্ত ঢিলেঢালা অংশ অথবা কোনো ক্যারেক্টারের শরীরের নরম অংশের ক্ষেত্রে গতি ও সময় সামান্য হেরফের হলে এ্যানিমেশনে বাস্তবতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।